কয়েকদিন আগে থেকেই নতুন দলের নাম ও শীর্ষ পদগুলোতে কারা আসছেন, সেই খবর প্রকাশ হতে থাকে গণমাধ্যমে।
আত্মপ্রকাশের সময় সেই তালিকা প্রায় অপরিবর্তিতই থাকে।
আহ্বায়ক হিসেবে নাহিদ ইসলাম এবং সদস্য সচিব হিসেবে আখতার হোসেনের নাম ঘোষণা করা হয়।
তিনটায় সময় নির্ধারিত থাকলেও অনুষ্ঠান শুরু হতে সাড়ে চারটায় গড়ায়। চার ধর্মের ধর্মগ্রন্থ পাঠের মধ্য দিয়ে শুরু হয় আনুষ্ঠানিকতা।
নতুন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা আসেন পাঁচটা নাগাদ।
তার আগে আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা আসেন অনুষ্ঠানস্থলে।
তাদের মধ্যে ছিলেন বিএনপি'র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ও যুগ্ম মহাসচিব শহীদ উদ্দিন চৌধুরী এ্যানি এবং জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার।
তারা নতুন দলকে স্বাগত জানানোর কথা বলেন।
দুইদিন আগে জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক (সাবেক) সারজিস আলম বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, অন্তত দুই লাখ লোকের সমাগম ঘটিয়ে নতুন দল ও নেতাদের নাম ঘোষণা করতে চান তারা।
কিন্তু, অনুষ্ঠানের জনসমাগম ততটা হয়নি বলে বিবিসি বাংলাকে ধারণা দেন একাধিক সংগঠক ও অনুষ্ঠান কাভার করতে আসা কয়েকজন সাংবাদিক।
তারপরও, নতুন দলের যাত্রা শুরুর দিনে বিপুল সংখ্যক মানুষের উপস্থিতি দেখা গেছে ঢাকার মানিক মিয়া এভিনিউতে।
দুপুর থেকেই অনুষ্ঠানস্থলে জড়ো হতে থাকেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকর্মীরা। ঢাকার বাইরের জেলাগুলো থেকেও অনেক নেতাকর্মী আসেন।
চট্টগ্রাম থেকে আসা দুই কর্মী জানালেন, তারা প্রায় ৫০ টি বাস ভর্তি করে এসেছেন কর্মসূচিতে যোগ দিতে।
জুলাই-অগাস্ট আন্দোলনে নিহতদের পরিবার এবং আহতরাও সমবেত হন সেখানে।
সাধারণত বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর সভার মঞ্চে চেয়ার টেবিলের ব্যবস্থা থাকে।
তবে, নাগরিক পার্টির মঞ্চে সেসব রাখা হয়নি। নেতারা সবাই মঞ্চের মেঝেতেই বসেন।
এটিকেও একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে বর্ণনা করেছেন কেউ কেউ।
সাদিয়া সুমি নামে এক নারী বিবিসি বাংলাকে বলেন, পুরনো রাজনৈতিক চর্চা দেখে ক্লান্ত তারা। নতুনদের কাছ থেকে নতুন চর্চার প্রত্যাশা তাদের।
সিয়াম মাহমুদ নামে অপর এক তরুণের মন্তব্য, বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের নেতারা অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়ে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটানোর মধ্য দিয়েই তাদের রাজনৈতিক যোগ্যতার প্রমাণ দিয়েছেন।
"তারা নতুন কিছু করতে পারবেন, এ ব্যাপারে আশ্বস্ত হওয়া যায়," যোগ করেন মি. মাহমুদ।
এনসিপি ক্ষমতায় যেতে না পারলেও সাধারণ মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলবে, এমন প্রত্যাশার কথা জানান, পিরোজপুর থেকে আসা বাবুল হাওলাদার।
বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের প্রতিক্রিয়া
'ছাত্রদের দল' গঠন নিয়ে বিএনপি বেশ কিছুদিন ধরেই সন্দেহ-সংশয় প্রকাশ করলেও আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে এসে সাংবাদিকদের কাছে নতুন দলটির সাফল্য কামনা করার কথা বলেন বিএনপি'র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী।
"একজন সাবেক ছাত্রনেতা হিসেবে আমি গৌরববোধ করছি, ছাত্ররা একটি জাতীয় পর্যায়ের সংগঠন করছে," যোগ করেন তিনি।
তরুণদের ভাষা ও বোঝাপড়াকে ব্যতিক্রম বলে রুহুল কবির রিজভী উল্লেখ করেন।
নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টিকে স্বাগত জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলটির সঙ্গে যে কোনো বিষয়ে আলাপ আলোচনার সুযোগ খোলা থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে আত্মপ্রকাশ করছে নতুন এই দল। তাদের আমন্ত্রণে আত্মপ্রকাশ অনুষ্ঠানে যোগ দেন জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেলসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতারা।
সম্প্রতি বিভিন্ন দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করছে জামায়াতে ইসলামী। নতুন দলের সঙ্গেও তারা আলাপ করবে কি না বা কোনো ধরনের জোটে যাবে কি না- এই প্রশ্নের জবাবে মিয়া গোলাম পরওয়ার বিবিসি বাংলাকে বলেন, আলাপ-আলোচনার পথ সবসময়ই খোলা থাকে। নতুন দলের ক্ষেত্রেও সেই সম্ভাবনা থাকবে।
শীর্ষ দশ পদে যারা
দলের আহ্বায়ক পদে আছেন নাহিদ ইসলাম। সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়কের দুটি পদে আছেন সামান্তা শারমিন ও আরিফুল ইসলাম আদীব।
সদস্য সচিব পদে আছেন আখতার হোসেন এবং সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিবের দুটি পদে তাসনিম জারা ও নাহিদা সারওয়ার নিবা।
দলের মুখ্য সংগঠক পদে আছেন তিন জন। মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী, মুখ্য সমন্বয়ক (দক্ষিণাঞ্চল) হাসনাত আবদুল্লাহ, মুখ্য সংগঠক (উত্তরাঞ্চল) সারজিস আলম।
যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক পদে আছেন আব্দুল হান্নান মাসউদ।
'সেকেন্ড রিপাবলিকের' শপথ
"বাংলাদেশে ভারতপন্থি বা পাকিস্তানপন্থি রাজনীতির কোনো ঠাঁই হবে না" বলে উল্লেখ করেন জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।
তার বক্তব্যে বার বার উঠে এসেছে বাংলাদেশে একটি 'সেকেন্ড রিপাবলিক' বা 'দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র' প্রতিষ্ঠার বিষয়টি।
২০২৪ সালের অভ্যুত্থান সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার লড়াই সূচনা করেছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "একটি গণতান্ত্রিক নতুন সংবিধান প্রণয়নের মাধ্যমে আমাদেরকে সাংবিধানিক স্বৈরতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সকল সম্ভাবনার অবসান ঘটাতে হবে।"
"সেকেন্ড রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার জন্য গণপরিষদ নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নতুন সংবিধান প্রণয়ন আমাদের অন্যতম প্রাথমিক লক্ষ্য।"
সেকেন্ড রিপাবলিক কেমন হবে তার একটি উদ্দেশ্যের রূপরেখাও তুলে ধরেছেন তিনি।
সেক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থ রক্ষায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিমুক্ত রাজনৈতিক সংস্কৃতি এবং সব নাগরিকের মৌলিক অধিকার ও সমান নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, এমন দিকগুলো তুলে ধরা হয়েছে।
"শহীদদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এই নতুন স্বাধীনতা একটি সরকার পতন করে আরেকটি সরকার বসানোর জন্যই ঘটেনি। জনগণ বরং রাষ্ট্রের আষ্টেপৃষ্ঠে জেঁকে বসা ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা বিলোপের মাধ্যমে একটি নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের আকাঙ্ক্ষা থেকে এই অভ্যুত্থানে সাড়া দিয়েছিল, যাতে করে জনগণের অধিকারভিত্তিক একটি রাষ্ট্র পুনর্গঠিত হয়," বলছেন তিনি।
সেই উদ্দেশ্যে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন তিনি।
বক্তব্য শেষ করার সময়ও সবাইকে সেকেন্ড রিপাবলিক গঠনের প্রতিজ্ঞা করছেন কিনা, সে প্রশ্ন রাখেন মি. ইসলাম।
এরপর "ইনকিলাব জিন্দাবাদ", "ক্ষমতা না জনতা, জনতা জনতা", "দালালি না রাজপথ, রাজপথ রাজপথ" এমন নানা স্লোগান দেন দলের শীর্ষ নেতারা।
Comments
Leave a Comment